প্রকৃতি আমাদের সুস্থ থাকার জন্য যেসব উপহার দিয়েছে, তার মধ্যে কাঠ বাদাম বা আমন্ড (Almond) অন্যতম। এটি কেবল সুস্বাদুই নয়, বরং পুষ্টিগুণে ভরপুর একটি সুপারফুড। ছোট-বড় সবার পছন্দ এই বাদামটিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ফাইবার, ভিটামিন ই এবং স্বাস্থ্যকর চর্বি। কিন্তু অনেকেই জানেন না কাঠ বাদাম খাওয়ার সঠিক পদ্ধতি বা এর প্রকৃত উপকারিতাগুলো কী।
আজকের এই আর্টিকেলে আমরা কাঠ বাদামের উপকারিতা, এটি খাওয়ার সঠিক নিয়ম, এবং বিভিন্ন ভুল ধারণা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
আরো পড়ুনঃ কাজুবাদাম : কাজু বাদামের উপকারিতা ও অপকারিতা
কাঠ বাদামের পুষ্টিগুণ
মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে জেনে নেওয়া যাক কাঠ বাদামে কী কী পুষ্টি উপাদান রয়েছে। প্রতি ২৮ গ্রাম বা এক মুঠো কাঠ বাদামে রয়েছে:
- ফাইবার: ৩.৫ গ্রাম
- প্রোটিন: ৬ গ্রাম
- চর্বি: ১৪ গ্রাম (যার মধ্যে ৯ গ্রামই মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাট)
- ভিটামিন ই: দৈনিক চাহিদার ৩৭%
- ম্যাগনেসিয়াম: দৈনিক চাহিদার ২০%
এছাড়াও এতে রয়েছে ক্যালসিয়াম, কপার এবং ভিটামিন বি২।
কাঠ বাদামের উপকারিতা
নিয়মিত কাঠ বাদাম খাওয়ার অভ্যাস আপনার শরীরে জাদুকরী পরিবর্তন আনতে পারে। নিচে এর প্রধান কিছু উপকারিতা আলোচনা করা হলো:
হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়: কাঠ বাদামে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড, যা হার্টের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এটি রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) এর মাত্রা কমাতে এবং ভালো কোলেস্টেরল (HDL) এর মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। ফলে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে: উচ্চ রক্তচাপ হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের অন্যতম কারণ। কাঠ বাদামে থাকা ম্যাগনেসিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যারা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন, তাদের জন্য এটি দারুণ পথ্য।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক: কাঠ বাদামে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ কম কিন্তু স্বাস্থ্যকর ফ্যাট, প্রোটিন ও ফাইবার বেশি। এটি রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। ম্যাগনেসিয়াম ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়াতে সহায়তা করে, যা টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী।
মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি: কাঠ বাদামকে বলা হয় ‘ব্রেন ফুড’। এতে থাকা রিবোফ্লাভিন এবং এল-কার্নিটাইন মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে সহায়তা করে এবং স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে। শিশুদের মেধা বিকাশে এটি অত্যন্ত কার্যকরী।
ত্বক ও চুলের যত্ন: ভিটামিন ‘ই’ ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে এবং বয়সের ছাপ দূর করতে সাহায্য করে। নিয়মিত কাঠ বাদাম খেলে চুল পড়া কমে এবং চুল মজবুত হয়।
কাঠ বাদাম খাওয়ার নিয়ম
যেকোনো খাবার থেকে সঠিক পুষ্টি পেতে হলে তা খাওয়ার সঠিক নিয়ম জানা জরুরি। কাঠ বাদাম খাওয়ার নিয়ম মেনে চললে এর পুষ্টিগুণ কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
ভিজিয়ে খাওয়া সবচাইতে উত্তম: বিশেষজ্ঞদের মতে, কাঠ বাদাম সবসময় আগের রাতে পানিতে ভিজিয়ে রেখে সকালে খোসা ছাড়িয়ে খাওয়া উচিত। কারণ:
- কাঠ বাদামের বাদামী খোসায় ‘ট্যানিন’ নামক একটি উপাদান থাকে, যা পুষ্টি শোষণে বাধা দেয়।
- ভিজিয়ে রাখলে বাদাম নরম হয় এবং হজমে সুবিধা হয়।
- এটি এনজাইম নিঃসরণে সাহায্য করে যা পরিপাকতন্ত্র ভালো রাখে।
কখন খাবেন ? সকালে খালি পেটে বা নাস্তার সাথে ৪-৫টি ভেজানো কাঠ বাদাম খাওয়া শরীরের জন্য সবচেয়ে ভালো। এছাড়াও বিকেলে স্ন্যাকস হিসেবেও এটি খাওয়া যেতে পারে।
কাঠ বাদাম খেলে কি ওজন বাড়ে ?
অনেকের মনেই একটি সাধারণ প্রশ্ন থাকে কাঠ বাদাম খেলে কি ওজন বাড়ে? যেহেতু এতে ফ্যাট ও ক্যালোরি বেশি, তাই এই ধারণা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। তবে বাস্তবতা ভিন্ন।
গবেষণায় দেখা গেছে, পরিমিত পরিমাণে কাঠ বাদাম খেলে ওজন বাড়ে না, বরং ওজন কমাতে সাহায্য করে। কারণ
- এতে থাকা প্রোটিন ও ফাইবার দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা রাখে,
ফলে অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা কমে। - এর মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাট শরীরের মেদ ঝরাতে সহায়তা করে।
তবে মনে রাখবেন, অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়। দিনে ৩০-৪০ গ্রামের বেশি বা এক মুঠোর বেশি বাদাম খেলে অতিরিক্ত ক্যালোরি জমা হয়ে ওজন বাড়তে পারে। তাই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইলে পরিমিত পরিমাণে দিনে ৮-১০টি বাদাম খাওয়াই শ্রেয়।
কাঠ বাদাম ও কিসমিস খাওয়ার উপকারিতা
কাঠ বাদামের সাথে কিসমিস মিশিয়ে খেলে এর পুষ্টিগুণ আরও বৃদ্ধি পায়। কাঠ বাদাম ও কিসমিস খাওয়ার উপকারিতা নিচে দেওয়া হলো:
রক্তস্বল্পতা দূর করে: কিসমিসে প্রচুর আয়রন থাকে এবং কাঠ বাদামে কপার থাকে যা হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সাহায্য করে। অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন এমন রোগীদের জন্য এটি চমৎকার দাওয়াই।
শক্তি বৃদ্ধি করে: কিসমিসের প্রাকৃতিক চিনি এবং বাদামের প্রোটিন দ্রুত শরীরে শক্তি যোগায়।
হজম শক্তি বাড়ায়: কিসমিস ও বাদামের ফাইবার কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে।
খাওয়ার নিয়ম: রাতে ৩-৪টি কাঠ বাদাম এবং ৫-৬টি কিসমিস পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। সকালে বাদামের খোসা ছাড়িয়ে কিসমিসসহ চিবিয়ে খান।
আরো পড়ুনঃ ক্ষতিকারক দিক এবং হাদিসে কালোজিরার গুণাগুণ
কাজু বাদাম ও কাঠ বাদাম খাওয়ার নিয়ম
অনেকে কাজু এবং কাঠ বাদাম একসাথে খেতে পছন্দ করেন। কাজু বাদাম ও কাঠ বাদাম খাওয়ার নিয়ম জানা থাকলে আপনি ঘরেই তৈরি করতে পারেন হেলদি মিক্সড নাট।
মিক্সড স্ন্যাকস: সমপরিমাণ কাজু ও কাঠ বাদাম (কাঁচা বা হালকা রোস্ট করা) মিশিয়ে একটি এয়ার টাইট বয়ামে রাখুন। বিকেলে চায়ের সাথে বা কাজের ফাঁকে এটি হতে পারে দারুণ নাস্তা।
স্মুদি বা শেক: দুধের সাথে কাজু ও কাঠ বাদাম ব্লেন্ড করে পান করলে সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয়।
সতর্কতা: কাজু বাদামে ফ্যাটের পরিমাণ কিছুটা বেশি থাকে। তাই যারা ওজন কমাতে চান বা হার্টের সমস্যায় ভুগছেন, তাদের কাজু বাদাম খাওয়ার ক্ষেত্রে পরিমাণের দিকে নজর দেওয়া উচিত। কাঠ বাদাম ও কাজু বাদাম একসাথে খেলে দিনে মোট ১০-১২টির বেশি খাওয়া উচিত নয়।
কাঠ বাদামের ক্ষতিকর দিক
সবকিছুরই যেমন ভালো দিক আছে, তেমনি অতিরিক্ত ব্যবহারে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও হতে পারে। কাঠ বাদামের ক্ষতিকর দিক গুলো জেনে রাখা জরুরি:
১হজমে সমস্যা: অতিরিক্ত কাঠ বাদাম খেলে পেট ফাঁপা, গ্যাস বা কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা হতে পারে। কারণ এতে প্রচুর ফাইবার থাকে যা শরীর সবসময় দ্রুত হজম করতে পারে না।
অ্যালার্জি: অনেকের বাদামে অ্যালার্জি থাকে। কাঠ বাদাম খাওয়ার পর যদি চুলকানি, শ্বাসকষ্ট বা র্যাশ দেখা দেয়, তবে দ্রুত খাওয়া বন্ধ করতে হবে।
কিডনির সমস্যা: কাঠ বাদামে অক্সালেট (Oxalates) থাকে। যাদের কিডনিতে পাথর বা গলব্লাডারের সমস্যা আছে, তাদের অতিরিক্ত কাঠ বাদাম খাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত।
ভিটামিন ই ওভারডোজ: অতিরিক্ত বাদাম খেলে শরীরে ভিটামিন ই-এর মাত্রা বেড়ে গিয়ে ঝাপসা দৃষ্টি বা মাথাব্যথার কারণ হতে পারে।
কিছু সতর্কতা
কাঠ বাদাম খাওয়ার সময় কিছু বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত:
তেতো বাদাম এড়িয়ে চলুন: তেতো বা বন্য কাঠ বাদামে সায়ানাইড নামক বিষাক্ত উপাদান থাকতে পারে, যা শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। সবসময় মিষ্টি কাঠ বাদাম কিনুন।
লবণ ও চিনি যুক্ত বাদাম: বাজারে প্যাকেটজাত লবণাক্ত বা চিনি মাখানো কাঠ বাদাম পাওয়া যায়। এগুলো উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ক্ষতিকর। সবসময় কাঁচা বা রোস্ট করা লবণমুক্ত বাদাম খাওয়ার চেষ্টা করুন।
চিবিয়ে খাওয়া: বাদাম খুব ভালো করে চিবিয়ে খাওয়া উচিত, অন্যথায় এটি হজম হতে সমস্যা করে এবং পুষ্টি শরীর শোষণ করতে পারে না।
পরিশেষে বলা যায়, সুস্বাস্থ্য রক্ষায় কাঠ বাদাম একটি অনবদ্য প্রাকৃতিক উপাদান। কাঠ বাদামের উপকারিতা পেতে হলে এটি সঠিক নিয়মে এবং পরিমিত পরিমাণে খাওয়া জরুরি। নিয়মিত সকালে ভেজানো কাঠ বাদাম খাওয়ার অভ্যাস আপনার হৃদপিণ্ড, মস্তিষ্ক এবং ত্বককে রাখবে সুস্থ ও সতেজ।
আপনার দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় আজই যুক্ত করুন এই সুপারফুডটি। তবে আপনার যদি কোনো বিশেষ শারীরিক সমস্যা বা অ্যালার্জি থাকে, তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে বাদাম খাওয়া শুরু করবেন। সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।
- আরো পড়ুনঃ কালোজিরার উপকারিতা, ও ক্ষতিকারক দিক
- আরো পড়ুনঃ বন টেপারি গাছের উপকারিতা ও ক্ষতিকর দিক
- আরো পড়ুনঃ এলাচ এর উপকারিতা ও ক্ষতিকারক দিক
আমাদের অন্য একটি সাইট ভিজিট করতে সাব্বির.XYZ তে ক্লিক করুন সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাপশন সহ পেয়ে যাবেন প্রয়োজনীয় নানান টিপস। ধন্যবাদ সবাই ভাল থাকুন সুস্থ থাকুন আল্লাহ্ হাফেয।


